নাসির আলী মামুন: এস এম সুলতান


/ শাহরিয়ার খান শিহাব







শেখ মোহাম্মদ সুলতান, ( জন্ম: ১০ আগস্ট ১৯২৩; মৃত্যু: ১০ অক্টোবর ১৯৯৪) যার জীবন এবং শিল্পকর্ম ছিল বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশি ঔপনিবেশিক এবং আভঁ-গার্দ চিত্রশিল্পী; একজন স্বাধীনচেতা ও ভবঘুরে স্বভাবের মানুষ। গতানুগতিক ধারার পড়াশুনা তিনি পছন্দ করতেন না ফলে কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে তিন বছর পড়াশোনার পর তা ছেড়ে দেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উপমহাদেশের বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে ব্রিটিশ ও আমেরিকান সৈন্যদের ছবি এঁকে জীবনধারণ করতেন। কাশ্মীরে থাকার সময় তিনি প্রচুর ছবি এঁকেছিলেন, কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর দেশে ফেরার সময় সেগুলো সেখানে রেখেই চলে আসেন। ভবঘুরে জীবনযাপনের কারণে সে সময়ের আঁকা বহু ছবি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক চিত্রশিল্প প্রদর্শনীতে সুলতানের আঁকা ছবি বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি, এবং পল ক্লির ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছিল। এই সম্মান অর্জনকারী তিনি ছিলেন প্রথম এশীয় শিল্পী। ১৯৭৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে একটি একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে সুলতানের প্রথম একক প্রদর্শনী। সে সময়কার তরুণ আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন প্রদর্শনীটি উপভোগ করতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি দেখেন একজন সাধারণ চেহারার মানুষ মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, যার শিল্পকর্মগুলো ছিল বিশাল ক্যানভাসে আঁকা এবং সম্পূর্ণ নতুন ঘরানার। এবং শিল্পকর্মগুলোর আকার, বিষয়বস্তু এবং প্রকাশের ভঙ্গি নাসির আলী মামুনকে মুগ্ধ করে। এইদিনই নাসির আলী মামুনের মনে সুলতানের আলোকচিত্র তৈরি করার আগ্রহ জন্মায়। আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন ঠিক করলেন এস এম সুলতানের আলোকচিত্র ধারণ করবেন।



© নাসির আলী মামুন / ফটোজিয়াম  



নাসির আলী মামুনকে বাংলাদেশে পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির জনক বলা হয়। কবি শামসুর রাহমান তাকে "ক্যামেরার কবি" উপাধি দিয়েছিলেন। নাসির আলী মামুন প্রধানত কালো-সাদা আলোকচিত্র ধারণ করেন। এই মাধ্যমে তিনি আলো-ছায়ার খেলাকে দারুণভাবে ব্যবহার করেন, যা তার আলোকচিত্রে এক নিরন্তর সৌন্দর্য বয়ে আনে। অন্যদিকে আলোকচিত্রকে করে মিনিমাল, সরল এবং নিস্তব্ধ। ফলে নাসির আলী মামুন উঠে আসে মানুষের আত্মা ও ইতিহাসের।

এস এম সুলতান ছিলেন প্রকৃতির মানুষ, তিনি শহর ও আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করতেন না। বাস করতেন জন্মস্থান নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে। ১৯৭৮ সালে নাসির আলী মামুন গেলেন নড়াইলে সুলতানের বাড়িতে, চিত্রা নদীর তীরে। সুলতানের বাড়ি নাসির আলী মামুনকে বিস্মিত করল। যেই বাড়িতে সুলতান বাস করে সেই বাড়ি একটি দুইশ বছরের পুরাতন দোতলা জমিদার বাড়ি। বাড়ির দরজা নাই, জানালা নাই, সাপ্লাইয়ের বিশুদ্ধ পানি নাই, বিদ্যুৎ নাই, বাড়ির চতুর্দিকে প্রতি দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, দেয়ালের আস্তর বলতে তেমন কিছু অবশিষ্ট নাই, বাড়ির ছাদগুলো ঢেউ ঢেউ, ফ্লোরও ঢেউ ঢেউ, অনেক জায়গার চলটা খসে গিয়েছে, অনেক জায়গা ভেঙে গিয়েছে। নাসির আলী মামুনের অনুভব হতে লাগল সে যেন বর্তমান থেকে দুইশ বছর আগের কোন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

নাসির আলী মামুন বিশ্বাস করেন, প্রতিটি মানুষের মুখে একটি গল্প লুকানো থাকে। সেই গল্পকে ক্যামেরাবন্দি করাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। সেই হিসেবে এস এম সুলতান একজন আদর্শ সাবজেক্ট। অন্যদিকে নাসির আলী মামুন প্রাকৃতিক আলো এবং পরিবেশে ছবি তুলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তার বেশিরভাগ বিখ্যাত ছবিই খোলা জায়গায়, বারান্দায় কিংবা ঘরের ভেতরে বা ব্যক্তির কর্মস্থলে ধারণ করা। কারণ তিনি মনে করেন প্রাকৃতিক পরিবেশে তোলা ছবিগুলো আরও বেশি বাস্তব ও জীবন্ত হয়। সেক্ষেত্রেও এস এম সুলতানের এমন জরাজীর্ণ প্রায় দুইশ বছর পুরাতন বাড়িকে আদর্শ স্টেজ হিসেবে ব্যবহার করা তার বাসনায় পরিণত হল। নাসির আলী মামুনের অনুভব হতে থাকে সে রেমব্রান্তের দুনিয়ায় উপস্থিত হয়েছে।

নাসির আলী মামুন ধীরে সময় নিয়ে এস এম সুলতানের আলোকচিত্র ধারণ করা শুরু করলেন। সুলতানের জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত অব্যহত থাকে এই আলোকচিত্র ধারণ করার প্রক্রিয়া। সুলতানের বাড়িতে গিয়ে এক একবার আট-নয়দিন কিংবা দশদিন করে থাকতেন নাসির আলী মামুন। ফ্লোরে একটি মাদুর পেতে ঘুমাতেন। তবে বালিশ ছিল না। চেষ্টা করতেন শীতকালে গিয়ে থাকতে। শীতের জামা কাপড় জুতা পড়ে ঘুমাতেন। সুলতান তার বাড়িতে শুধু মানুষ হিসেবেই বাস করতেন না, বরং প্রকৃতি ও পশুপাখির সাথে একাত্ম হয়ে থাকতেন। বাড়িতে বিড়াল, বানর, সাপ এবং অন্যান্য প্রাণীদের অবাধ বিচরণ ছিল। সকলের সাথে কথা বলতেন এস এম সুলতান। রাতে নাসির আলী মামুন ভয়ে ঘুমাতে পারত না।

এই ঘরের বর্ননা দিতে গিয়ে মুনেম ওয়াসিফকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নাসির আলী মামুন বলেন, “সুলতান প্রায় প্রত্যেকদিন রাইতের বেলায় আসত। জীব জন্তুগুলা যখন বেশি আওয়াজ করত, ডাকাডাকি করত তখন সে আসত রাইতে, আমি চোখ বন্ধ করতাম। চোখ বন্ধ কইরা টেরা ভাবে তাকাইয়া দেখতাম যে ও কি করে। ও ঘরে ঢুকা মাত্র, ওর শরীরের ঘ্রাণ, মুখে যখন আওয়াজও করত না… ওর শরীরে যে একটা আদিম বন্য গন্ধ ছিল সুলতানের সেই ঘ্রাণগুলি ওরা পাইত। ওই পশু-পাখিগুলা, জীব-জন্তুগুলা সাথে সাথে ওদের আওয়াজ বন্ধ হইয়া যাইত এবং প্রত্যেকে চোখ-মুখ বাইর কইরা ওর দিকে তাকাইয়া থাকত। সুলতান ওদের সাথে কথা বলত। প্রত্যেকটার সাথে কথা বলত। এমন একবার বলতেছিল যে, তোরা মেহমানকে জ্বালাস না। ও ঢাকা থেকে আইছে, ফডুতোলা মানুষ, ওর ঘুমোন দরকার। কাইল সকালে আমরা গেরামে যামো। চ্যাঁচোরপুরুলিয়া যামো। ওরে ঘুমোতি দে। তোদের আজ খাওয়ানো হয় নাই, কাইল খাওয়াবো। পশু-পাখিগুলা, জীব-জন্তুগুলা চুপ কইরা থাকত। যেই উনি বাইর হইয়া যাইতেন, তখনি ওরা আবার চেঁচামেচি শুধু কইরা দিত।”

যদিও কয়েকবার নাসির আলী মামুনের মনে হয়েছে এই পাগল এস এম সুলতাকে খুন করতে কিন্তু মামুনের জন্য সুলতানের বাড়িতে যাওয়া কেবল ছবি তোলার উদ্দেশ্য ছিল না, বরং তার জীবন ও দর্শনকে বোঝার একটি ব্যাপক প্রয়াস ছিল। তিনি সুলতানের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলতেন, তার শিল্পভাবনা এবং জীবন নিয়ে আলোচনা করতেন। এই ঘনিষ্ঠতা ও বোঝাপড়ার কারণে মামুন এমন ছবি তুলতে পেরেছেন যা সুলতানের বাহ্যিক রূপের চেয়ে তার ভেতরের সত্তাকে বেশি প্রকাশ করে। সুলতানের আঁকা বিশাল ক্যানভাসের ছবি এবং তার দৈনন্দিন জীবনের সাদাসিধে চিত্রগুলো মামুন ক্যামেরাবন্দি করেছেন, যা শিল্প ও জীবনের মধ্যে এক অসাধারণ সম্পর্ক স্থাপন করে।

নাসির আলী মামুনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো প্রতিকৃতি বা পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি। তিনি শুধুমাত্র মানুষের চেহারা নয়, বরং তাদের ভেতরের সত্তা, মনস্তত্ত্ব এবং চরিত্রের গভীরতাকে ক্যামেরায় ধারণ করেন। তার আলোকচিত্রে ব্যক্তিত্বের যে সূক্ষ্ম দিকগুলো উঠে আসে, তা এক কথায় দুর্লভ।



Copyright of the photograph belongs to Nasir Ali Mamun/ Photoseum. Any part of this article cannot be used without the written permission of the author.