মনজুর আলম বেগ: একটি ছবির অনুধাবন
/ দীন মোহাম্মদ শিবলী

© মনজুর আলম বেগ
মানুষের সংকেত নির্ভর যোগাযোগ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। কিন্তু সেটি একটি নীরব সামাজিক প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানব শিশু অবলীলায় (ব্যতিক্রম বাদে ) শিখে যায়। তবে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গণযোগাযোগ আলোচনায় পারসেপশন বা অনুধাবনকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এই অনুধাবন প্রক্রিয়াটি মূলত মানুষের বাহ্যিক স্তরে আলাদাভাবে শেখানো হয় না; এটি মানুষের নিজের মধ্যে নিজস্ব স্পেসে ঘটে। আর একটু ব্যাখ্যা করি, এটি ব্যক্তির পারিপার্শ্বিকতা, সামাজিক স্তরে অবস্থান, শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া, দৈনন্দিন যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিক চরিত্র ইত্যাদি নানান চালকের মিথস্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠে।
অত্যন্ত ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে মানুষ 'অন্ত:ব্যাক্তিক (মানব যোগাযোগের প্রথম স্তর) যোগাযোগ' করতে সক্ষম এবং এর মধ্য দিয়ে তার অনুধাবন প্রক্রিয়াটি ক্রমাগত শাণিত হতে থাকে। এই অনুধাবন প্রক্রিয়ার আলোচনার মধ্যে রেখে ক্যামেরায় ধারণকৃত দ্বিমাত্রিক স্থির ছবির বিশ্লেষণ করা দরকার। একটি ছবি কখন পূর্ণাঙ্গতা পায়? যখন সেটি শ্রোতা বা অডিয়েন্সের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। এখানে বলে রাখা ভালো, একজন আলোকচিত্রীকে আমরা যোগাযোগ কাঠামোর আলোচনায় এনকোডার বলি আর শ্রোতাকে বলি ডিকোডার। এই বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি বা এনকোডার ক্যামেরার কারিগরিতা ও 'অনুধাবন কাঠামোর রিভার্সাল প্রয়োগ' করে ছবি নির্মাণ করেন। ছবি কখনোই বাস্তব নয়; এটি সব সময় নির্মিত বাস্তব! এটি বাস্তব জগতে অস্তিত্ববান বা দর্শনযোগ্য উপাদান দিয়ে তৈরি আলোকচিত্রীর সেই বুদ্ধিমান নির্মাণ, যা অর্থ বা মিনিং তৈরি করতে সক্ষম। এটি একটি জটিল ও বহুমাত্রিক যোগাযোগ প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
গণযোগাযোগের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগের এই ছবিটি আমার নজরে আসে বছর দু'য়েক আগে। আমি তখন থেকেই ভাবতে শুরু করি ছবিটি নিয়ে। প্রথম দেখায় আমার যে ধাক্কাটি লাগে সেটি মূলত ছবির জন্য নয়; বরং আমি অনুধাবন করি যে, এম এ বেগেকে আলোকচিত্র-শিল্পী হিসেবে এতদিনে যে অবয়ব দেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং পাশাপাশি অগ্রহণযোগ্য। আমি ভাবতে শুরু করলাম তাঁর এই অবয়ব নির্মিত হয়েছে কাদের হাত ধরে? সাধারণভাবে লক্ষ্য করলাম যে, মূল সমস্যা কোনো ব্যক্তি বা ব্যাক্তি এম এ বেগ বা তাঁর ছবির নয়। বরং সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে তথ্যের অপ্রতুলতা এবং গবেষণার অভাব। আমরা তাঁর অবয়ব তৈরি করতে পারিনি। কেননা তাঁর ছবিসমূহ আমাদের সামনে উন্মুক্ত ছিল না। আলোচ্য ছবিটির মতো অন্তত ২৫ টি ছবির একটি দীর্ঘ ও পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ করা গেলে আমরা জাতির সামনে আলোকচিত্রাচার্যের একটি শিল্পী অবয়ব পেতে পারতাম। এটি অত্যন্ত জরুরি একটি কাজ ছিল। কিন্তু সেটি করা হয়নি। ফলে তাঁর নানা ধরনের ভুল ও ভ্রান্ত অবয়ব তৈরি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে 'কামরা' প্রকাশনার প্রথম সংখ্যায় তানজিম ওয়াহাবের একটি ছবির বিশ্লেষণকে উপস্থাপন করা যেতে পারে। তানজিম আলোকচিত্র-শিল্পী এম এ বেগের কাশফুলের মাঠে তিন রাখালের দাঁড়িয়ে থাকা ছবির বিশ্লেষণকে একটি ঋণাত্মক জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন। কারণ তার আলোচনার পাটাতনটি ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ ও স্টেরিওটাইপড্। যদিও আমি তার এই আলোচনাকে গ্রহণ করি। কেননা তানজিম ফটোগ্রাফির স্যালন আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে এম এ বেগের অবয়বটি তৈরি করে আলোচনাটি সম্পন্ন করেছেন। সেজন্য 'একজন আলোকচিত্রীর একটি ছবি'র আলোচনাকে আমার কাছে বিপদজনক পদ্ধতি হিসেবে সব সময় মনে হয়েছে। ক্যালেন্ডারের মতো প্রকাশনা অবশ্য একটি ব্যতিক্রম হতে পারে। কিন্তু বই বা জার্নালে এই পদ্ধতি কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি নয় বলে গবেষক হিসেবে আমার ধারণা।
প্রথম দেখায় আমার অনুধাবন হলো এই ছবিটি মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন কাজের চিত্র। ফটোগ্রাফির ভাষায় আমরা যাকে বলি ডেইলি লাইফের ছবি। এই মধ্যবিত্ত চলকের ধারণাটি শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ। কিন্তু অনুধাবন প্রক্রিয়ায় একজন অডিয়েন্স বা শ্রোতা হিসেবে মধ্যবিত্ত চলকটিকে বুঝতে পারা আমার জন্য খুব সহজ এবং তৃপ্তিদায়ক। একটি কার্যকর যোগাযোগ সম্পন্ন হলে মানুষ মানসিকভাবে তৃপ্তিবোধ করেন। এখানে যেহেতু শ্রোতা হিসেবে আমার অবস্থান মধ্যবিত্তে (অন্তত আমার অনুধাবন তাই বলে); সেহেতু ছবিটি দেখে যোগাযোগের এই তৃপ্তি ঘটে প্রথমেই।
এখন এই ছবিতে যে তথ্যগুলো নেই সেগুলো সংযুক্ত করতে শুরু করি। পাঠক স্মরণ করিয়ে দেই, মানুষের দেখার প্রক্রিয়ায় 'ছবি দেখা বা পড়া' সংক্রান্ত আমাদের কোনো পারিবারিক, সামাজিক বা একাডেমিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই! ফলে ছবি দেখার মধ্য দিয়ে নির্মিত অর্থ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভীষণ পার্থক্য তৈরি হয়। এখানে মূলত দায়ী সেই অনুধাবন প্রক্রিয়া। আলোকচিত্রী হিসাবে বা যোগাযোগের এনকোডার হিসেবে এম এ বেগ কোন চিন্তা থেকে এই ছবি তুলেছেন সেই তথ্য আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলমান রাখা সম্ভব। কোন হিসাবে বা পরিপ্রেক্ষিতের বিবেচনায়? সেটি হলো, শ্রোতার অনুধাবন প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে।
এই ছবিটির সাথে আরো নির্দিষ্ট করে একটি তথ্য সংযুক্ত করি। ছবিটি ঈদের আগের দিন অর্থাৎ চাঁদরাতের দিন তোলা। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চলে আসে। ঈদ কি? এটি কেমন ধরনের অনুষ্ঠান? বাংলাদেশের মতো মুসলিম প্রধান দেশে ঈদের অর্থ কেমন? চাঁদরাত কি? চাঁদরাতের সামাজিক প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য কেমন? এরকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর শব্দে বোঝানো দুষ্কর। অনুভব, অনুভূতি এবং নির্দিষ্ট সমাজে বসবাস করলে এগুলোর সাধারণ অনুধাবন তৈরি হয়। ফলে খুব সাধারণ একটি কর্মের ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে একজন ছেলে নিজের ও পরিবারের অন্যদের বেশ কিছু জোড়া জুতা বেলকনিতে সূর্যের নরম আলোয় বসে রং ও পলিশ করতে বসেছেন। অন্য আরেকজনের গায়ে জড়ানো চাদর দেখে বোঝা যায় এটি শীতকালে তোলা হয়েছে। এখানে শীতকাল আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এখন শ্রোতা হিসেবে আমার অতীত অভিজ্ঞতার সাথে কর্মটি হুবহু মিলে গেছে। সম্ভবত এদেশের কোটি কোটি মধ্যবিত্ত পরিবারের চাঁদরাতের দিনের বেলার অত্যন্ত সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটি, যা ছবিটা দেখা যাচ্ছে। ছবির এই আলোচনায় এরকম আরো অন্তত পাঁচটি তথ্য সংযুক্ত করা যাবে। সংক্ষিপ্ত পরিসর হওয়ায় সেই পথে গেলাম না। তবে তা করা গেলে আলোকচিত্রাচার্য এম এ বেগের তোলা এই ছবির বিশ্লেষণ এমন একটি জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, যার মধ্য দিয়ে মূলত এদেশে একটি কালের সামাজিক সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, চর্চা ইত্যাদির স্পষ্ট আকর বা অবয়ব ফুটে উঠবে।
Copyright of the photograph belongs to Manzoor Alam Beg. Any part of this article cannot be used without the written permission of the author.