রশীদ তালুকদার: দৃশ্য-অদৃশ্যের দ্বান্দ্বিকতায়


/ খন্দকার তানভীর মুরাদ







আলোকচিত্রী রশিদ তালুকদারকে বেশীর ভাগ মানুষ চেনে তাঁর রায়েরবাজার বধ্যভূমির ছবি দিয়ে। এলোমেলো কতগুলা ইট দিয়ে ঢাকা, কাদামাখা পানি, তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে একটি মৃত, ক্ষতবিক্ষত মুখ। শরীরের বাকি কোন অংশ দৃশ্যমান নয়। উপড়ানো চোখ দুটিতে শূণ্য কালো গহ্বর। রশীদ তালুকদারের তোলা এই ছবি পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর সংগঠিত গণহত্যার একখণ্ড প্রমাণ।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম, শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ, শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট, মাওলানা ভাসানী, নজরুল, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ছাড়াও অসংখ্য উত্তাল সময়, ছোট-বড় ঘটনার সাক্ষী তাঁর ক্যামেরা। রশীদ তালুকদার-এর সাদাকালো ছবির রাজনীতি ও জীবনযাপনের স্রোতধারা হয়ে উঠেছে এই জনপদের ইতিহাসের মূল্যবান দলিল।

ফটোসাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘজীবন দৈনিক সংবাদ ও ইত্তেফাকে কাজ করলেও, তাঁর কাজের পরিধি কখনই সংবাদপত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ছবি তুলেছেন। পরবর্তী সময়ে বিপিএস’এ যোগদান ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ। সেই সময়ের  আলোকচিত্রীদের একমাত্র স্থান যেখানে ছবির এস্থেটিকস, ছবির  গঠন, ছবিকে ঘিরে আলোচনা হতো। প্রেস ফটোগ্রাফাররা এক অর্থে ওইদিকে পা'ই মাড়াতেন না। বলা হয়ে থাকে সংবাদভিত্তিক ছবির বাইরে রশীদ তালুকদার যে নতুন নান্দনিক মাত্রা যোগ করেছিলেন, তার সূত্র বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির আনাগোনার মধ্যে দিয়েই শক্ত হয়।

বয়ানটি আমরা জানি শিল্পী মুনেম ওয়াসিফের লেখা থেকে। রশিদ তালুকদারের ছবি নিয়ে লিখতে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে ঘাটাঘাটি করাতেই সামনে এলো। 


ছবির সময়কাল সত্তরের দশক, স্থান মির্জাপুর, বাংলাদেশ।   © রশীদ তালুকদার / দৃক/ মেজরিটি ওয়ার্ল্ড




উল্লেখ্য ছবি নিয়ে লিখতে গিয়ে ছবির বিষয় বস্তুর যে গভীর ভালোবাসাময় গল্পের অবতারণা করে তার বাইরের বা আগের সময়কালের হাতি পোষ মানানোর যে হৃদয়বিদারক ঘটনা প্রবাহ তা আমার মনকে দ্বিধান্বিত করে ফেললো। যদি গল্পের খাতিরে বা ছবির অদৃশ্যমান বয়ানকে আলাদা রেখে লিখতে যাই তাহলে ৩৫ মিলিমিটারে তোলা এই সাদাকালো ছবিটি প্রকৃতির এক বিশালদেহী চালাক প্রাণী হাতি আর মানুষের আনন্দময় সময় কাটানোর এক সুন্দর গল্প বলে।   

দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বুনো হাতির দেখা মেলে বটে, তবে আমাদের দেখা বেশিরভাগ হাতিই মানুষের ঘর-সংসারে গৃহপালিত পশুর মতো ব্যবহার করা, ভার বহন করার বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে।

গ্রীষ্মকালীন প্রচণ্ড গরমে পানির সংস্পর্শে থাকতে পারাটাই আনন্দময়, তা হোক সে হাতি বা মানুষ। বাচ্চারই বাংলার নদী-নালা-খাল-বিলের প্রধান উপভোগতা। গরমে গ্রাম-গঞ্জের শিশুরা একটা বড় সময় পানিতে আনন্দময় সময় কাটায়। সেই আনন্দ আরও কয়েকশো গুন বেশি হয়ে যায় হাতির মতো সঙ্গী পেলে। মাহুতের সাথে পানিতে নেমে হাতির আনন্দ যেন আরও বেড়ে গেছে শিশুদের পেয়ে। দৈহিক ভঙ্গি বলে দেয় এই গ্রামীণ শিশুরা তার কত আপনজন। হাতি তখন আর কেবল মহাশক্তিধর প্রাণী নয়, বরং হয়ে উঠত তাদের খেলার সঙ্গী - গগনচুম্বী এক ‘রাবার হাঁস’, যার পিঠে ভেসে কেটে যায় আনন্দঘন সময়।

আলোকচিত্রের শক্তিমত্তার জায়গা হলো, যা দেখানো হলো না তাও বলা হয়ে গেলো। লিখতে গিয়ে ছবির অদৃশ্যমান বয়ান - মানুষ প্রকৃতিকে পোষ মানাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির যে অপব্যবহার তা যেন মানব সভ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

আমি জানি না রশিদ তালুকদার নিজে এই ছবি নিয়ে লিখলে কী কী প্রসঙ্গ নিয়ে লিখতেন। কিন্তু আমি লিখতে গিয়ে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান এই দ্বান্দ্বিকতার টানাপোড়েনে পরে ছবির ভাষার দ্বন্দ্বকে নতুনভাবে অনুভব করলাম। একই সাথে এই দ্বান্দ্বিকতা চিত্রগ্রাহক আর চিত্রপাঠকের চিন্তা, দেখার ভঙ্গী, গঠন আর গল্প বিশ্লেষণের টানাপোড়েন।   



Copyright of the photograph belongs to Rashid Talukder/ Drik/ Majority World. Any part of this article cannot be used without the written permission of the author.