গোলাম কাশেম: নিরুদ্দেশ ভাবনার চোখ


/ আরফান আহমেদ








ছবি: উদাসী, হাওড়া, ১৯১৮।  © গোলাম কাশেম / দৃক/ মেজরিটি ওয়ার্ল্ড
 


গ্লাসপ্লেট নেগেটিভের ছোট্ট একটা ছবি। নরম আলোর সময়ে বেতের চেয়ারে বসা এক কিশোরী। বসবার ভংগিটা অদ্ভুত। চেয়ারের পিছনের দিকে হাতের ওপর হাত রেখে তার উপরে থুতনী, তারো ওপরে কিশোরীর নিরুদ্দেশ ভাবনার চোখ। পাটের মতন চুল মাঝখানে সিঁথি তার ওপারে ফুল এবং গুল্মের বাগান, বাগানে স্বাবলম্বি ঘাস ইচ্ছে খুশি বেয়াড়া। তার ওপারে ছোট বাংলা ঘর, বাঁশের বেড়া, আর ঢেউ খেলানো ইস্পাতের ছাদ। তারো ওপারে কিছু গাছ তারপর আকাশের ছোট্ট নিশান।

কিশোরীর স্বযতনে উদাসী মুখের ভাব। ফ্রেম ভেদ করে বেরিয়ে যায় তার চোখের দৃষ্টি। কালো মণিটা কার সাথে যেন কথা বলে, আমাদের মুখ ছাপিয়ে। বুঝতে পারি, ফটোগ্রাফার, এই সবই মিলে সাজিয়েছেন ছবি। একটা মিষ্টি ছবি। কৈশোর যেমন মিঠা হয়, যত্ন করে যেমন ঠিক আকুল হয়। কিশোরী, নজরের এমন সামনে, তাই ডিফোকাসড হয়ে আসে। এই যে কৈশোরের মায়া, তারে ঠিক ধরে উঠা যায় না। আর আমরা যা দেখি, তা অতি সাধারণ। আর যা দেখতে গিয়েও ধরতে পারি না, তা অসাধারন। ঠিক এই ছবিতেই জয়নুলের পেইন্টিং, লাল শাড়ি পরা নারী, যার পায়ের কাছে আয়নাটা উল্টো করে রাখা, চোখ বুঁজে, কোন গহীনে, কি যেন সে খোঁজে।

গোলাম কাশেম, দেখেছেন কত কিছু। বেবিব্রাউনি কামরার অন্ধকারের ভেতর কত মনিমানিক আলোক সাজিয়ে, কাগজের দ্বীতলে এমন ইশারার ভার, ফটোগ্রাফের সীমানা পেরিয়ে চোখের সামনে হুহু করে আসে অবিভক্ত বাংলার দেশ।

তাঁর কৈশোরের প্রেমে ছিলেন একজন এলসি। বলেছিলেন গ্লাসপ্লেট নেগেটিভ ডেভেলপ করতে পারলে তার সাথে ঘুরতে যাবেন। কাশেম তারপর একা একা কাটিয়েছেন সারা জীবন। গ্লাসপ্লেট নেগেটিভ থেকে সেলুলয়েড, এইসব রূপালী রসায়নে কখনো এলসি এসেছে, এলসি চলে গেছে।

গান গাইতেন নাকি, হাতে লেখা খাম চিঠি। বাঙালী মুসলমান, সে সময়ে আলোকচিত্রে তিনিই প্রধান। প্রথমও হবেন হয়তো সৌখিন দুনিয়ার। আচার্য মনজুর আলম বেগ তাই নাম ধরে দেন ড্যাডি। তার ইন্দিরা রোডের সেই বাড়িটায়, বাঙালীর আলোকচিত্রের প্রথম নায়কেরা গুলজার করে রাখতেন। সেই ভাবুক কিশোর কবেই হাত ধরে বাঙালীর আলোকচিত্রের যৌবন টেনে এনেছেন। বেঁচেও ছিলেন এক শতক। প্রথম বাঙালী মুসলমান গল্পকার, সওগাত পত্রিকায় তার খোঁজ পেয়ে যাবেন। তারপরতো অই কালো কামরার নেশায় আর কিছু হয়ে ওঠা হল না। ট্রপিকাল ইন্সটিটিউট থেকে ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব, এই সবই তাঁর গড়া। কি অদ্ভুত মানস অভিযানে কেটে গেল জীবন। জন্মের পরপরই মায়ের বিয়োগ ভালবাসার কোন ঘাটতি রেখেছিল কি? আমি জানি না। কিন্তু তাঁর ছবিতে যে অদ্ভুত প্রেম থাকে, একটা পালকের মতন ভালবাসা থেকে তা কোথা থেকে আসে আমরা হয়তো আঁচ করতে পারি। পেশাদার হননি কখনো, তাই হয়তো ছবিগুলোতে থাকে কিছু অপরিমেয় মায়া। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস শেষে জীবনের শিল্পের সব সঞ্চয় বিলিয়ে দিলেন। আজকে যে দেশি মেয়েটা একটা ছবি নিজে নিজে আবিষ্কার করে নিজেকেই নিজে তাক লাগিয়ে দেয়, ড্যাডি সেখানেও বিহার করেন হয়তো।

আলোক বিহারি গোলাম কাশেম ড্যাডি।


নোট: পাঠশালা, সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউটের ফেসবুক পোস্ট, ২০২০ থেকে নেয়া হয়েছে।



Copyright of the photograph belongs to Golam Kasem/ Drik/ Majority World. Any part of this article cannot be used without the written permission of the author.