আজিজুর রহীম পিউ: জার্নালিস্টের ডায়েরী


/ তানজিম ওয়াহাব








© আজিজুর রহীম পিউ/  দৃক/ মেজরিটি ওয়ার্ল্ড


রাত যতই বাড়ুক চিপা, ঘিঞ্জি, অন্ধকার কোন গলিতে প্রায় সবার আগেই ঘটনাতে হাজির হত উইজি। এত অল্প সময়ে ঘটা কাহিনীর কূলকিনারাই তো পাওয়া কঠিন, উইজি ছিল জটিল জিনিস, তার ছিল গোপন আর অসম্ভব সব কারবার। গাড়িতে সে যোগাড় করল পুলিশের রেডিও যাতে লাগাতার পুলিশের বাচিত শোনা যায়, গাড়ির ডেকচিতে ছিল উইজির চলন্ত ডার্করুম, যাতে ছবি তোলার সাথে সাথেই ছবি ধোলাই করা যেত। উইজি আসল নামটা পর্যন্ত গায়েব করে, আসল নামটা ছিল তার আর্থার ফেলিং। এভাবে রহস্যময় গাড়িটা হাঁকিয়ে মাথা গরম করা ঘটনার ছবি তুলত সে। খুন, রক্ত, গাড়িচাপা, থেতলানো মাথা, মগজ, মুখ ভচকানো কান্না। এই ছবিগুলো তোলা তো খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব- চাইলেও বেশিরভাগ ফটোগ্রাফার পারবে না। সবকিছু ম্যানেজ করে জায়গায় পৌঁছানো তো একটা দিক, ঘটনা হজম করে মেরুদণ্ড সোজা রাখা আর ক্যামেরার বোতাম টেপা যে কারও জন্য কঠিন। আর কেউ সেটা পেরে উঠলে পিঠ চাপড়ানো বাহবা জুটতেই পারে। উইজির হাতে বিশাল রিং ফ্ল্যাশ সহ ক্যামেরা আর মুখে গুঁজা সিগারসহ চেহারাটা প্রায় ছবিতেই দেখা যায়, যেখানে তাকে খুবই গর্বিত মনে হয়, একরকম শিকার ফেরত শিকারির মত। উইজিরা নায়ক হয়ে ওঠে, বিখ্যাত হয়, ঠিক যেন যুদ্ধের সুদর্শন ফটোগ্রাফার রবার্ট কাপার মত।

টানটান উত্তেজনা! সময়ের আগে তাদের দৌড়াতে হয়। চোখে সানগ্লাস, পিঠে ক্যামেরার ব্যাগ, শরীরে ছড়ানো অনেকগুলো পকেট আর প্যাঁচ দিয়ে থাকা যন্ত্রপাতি-ক্যামেরা, ফ্লাশ, ফিল্ম। ভালই ভাবসাব! দুপুর বেলায় ঢাকা ভার্সিটি টিএসসির সামনে অনেকগুলো মোটর সাইকেল গায়ে গায়ে লেগে থাকে আর পাশে চায়ের টঙে আড্ডা চলে। তারা এই আছে, এই নাই। হঠাৎ ফোন বাজলেই বাইকটা চেপে দে ছুট। প্রচণ্ড গরম আর টেনশনে ঘেমে গোসল, রাস্তা জুড়ে ট্রাফিক জ্যাম, হর্নের কর্কশ ভোঁ ভোঁ শব্দ। ঘটনায় হাজির হওয়ার সাথে সাথেই বাকিদের ভীড়, কুস্তি লড়তে হয়, কনুই মেরে সামনে আসতে হয়। ফলাফলে কেউ ক্যামেরাটা ভেঙ্গে দিতে পারে, শার্টের কলার টেনে সজোরে কিল ঘুসি খাওয়াও সম্ভব। যত কিছুই হোক সবার আগেই সামনে গিয়ে ছবিটা পাওয়া লাগবেই, এডিটর সাহেব সেটাই চায়। বিদেশের প্রেস ফটোগ্রাফির সাথে তুলনা করলে এদেশের অবস্থা অনেক শোচনীয়, যেখানে পত্রিকায় একজন ফটো এডিটরের পদ নাই, কারও ভাল ছবি বোঝার বালাই নাই, ছাপানো ছবিতে ফটোগ্রাফারের নাম নাই, বেতন নাই, ভাল ক্যামেরা নাই। সবকিছু জেনেও তারা ছোটে।

তাদের জীবনটা সিনেমার নায়কদের থেকে এক ইঞ্চিও কম রঙিন না। কিন্তু ভেতরের অনেক মোচড় আমরা দেখি না, দেখতে পাই না। তারা নিজেরাও হয়ত শুরুতে টের পায় না কি এক মানসিক যাতনায় তারা ঢুকবে। ৯৪-এ দক্ষিণ আফ্রিকায় যখন গৃহযুদ্ধের দাঙ্গা, তখন ব্যাং ব্যাং ক্লাবের অল্প বয়সী ফটোসাংবাদিকরা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়ে। এক গোত্রের মানুষ আরেক গোত্রের কাউকে পেলে চোখের সামনে দিনে দুপুরে কুপিয়ে মারে, দাউ দাউ আগুনে জীবন্ত সব শরীর পুড়ে ছারখার হয়, চারিদিকে ধোঁয়া। ফটোগ্রাফারগুলো চোখের সামনে নির্বিচারে হত্যা দেখে, ছবি তোলে কিন্তু টু শব্দও করে না, কাউকে বাঁচাতে পারেনা। শব্দ করলে হয়ত নিজের জান যাবে, আর সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে শব্দ না করাটা কি আরও কঠিন না? এই ঘটনাগুলো হজমের পর বাড়িতে গিয়ে আসলে কি হয়? হয়ত তারা নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষকেও বোঝাতে পারেনা কি দুর্বিষহ সব অভিজ্ঞতা তাদের মন কুঁকড়ে কুঁকড়ে মারে।

ব্যাং ব্যাং ক্লাবের ফটোগ্রাফার কেভিন কার্টার হঠাৎ চোখের সামনে দেখে হাড্ডিগুড্ডি বের হওয়া খুব ছোট বাচ্চার মরার ঠিক আগের দৃশ্য। তাতে আরও যোগ হয় একটা শকুন, মাংসের গন্ধে মাতাল হয়ে পিছনে অপেক্ষা করছে। কেভিন ফাটানো একটা ছবি তোলার মোক্ষম সুযোগটা পায়, হাতছাড়া করে না, আবেগের প্যাঁচে না পড়ে ছবিটা তুলে, বিনিময়ে জুটে জগৎ কাঁপানো পুলিৎজার পুরুস্কার। কিন্তু ছবি তোলার পর বাচ্চাটার কি হয়েছিল কেভিন জবাব দিতে পারেনি, মানুষ সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে কেভিন কেন তাকে বাঁচায় নাই। কেভিন কিছু বলে নাই, তার কিছুদিন পর কেভিনের মুখে তেলের পাইপ গুঁজে আত্মহত্যাটা রহস্য আরও বাড়িয়ে দেয়- আঁচ করায় প্রেস ফটোগ্রাফারদের ভয়াবহ এই মানসিক দ্বন্দ্বের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে! বাইরের সিনেমার নায়কদের বেশ সেটা আমাদের বিন্দুমাত্র টের পেতে দেয়না।

আমি জানিনা আজিজুর রহীম পিউয়ের পাশের ছবিটা তোলার সময় মনের ভেতর কত ভয়াবহ দহন ছিল। ৯৪ এর রাতে পিউ তার বিচক্ষণতায় ঢুকে পড়ে মিরপুরের এক গার্মেন্টসে। নির্দিষ্ট একটা ঘরই খুঁজছিল সে। সেই ঘরে নাকি দেখা মিলবে গার্মেন্টসে কাজ করা ছোট ছোট বাচ্চাদের। যত দূর আঁচ করা যায় ঘটনা ঘটে গেছে। ভয়াবহ কিছু দেখার জন্য মনকে প্রস্তুত রাখে সে। ঘরটা শেষমেশ খুঁজে পায়, জীবন বাজি রেখে ঢুকে পড়ে; পিউ এর ক্যামেরায় নগ্ন হাতে ধরা পড়ে নির্মমতার চূড়ান্ত দৃশ্য। ফ্লাশের আলোতে জ্বলে ওঠে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা ছোট ছোট সব গার্মেন্টস কর্মী। আরও জ্বলে ওঠে অন্ধকার ঘরে চোখে কালো সানগ্লাস গুঁজা ভদ্রলোক আর তার সঙ্গী। শক্তভাবে হাতের মুঠি দুটো ধরে তুলে ফেলল একটা বাচ্চাকে, আর ত্রিভূজের আরেক কোণায় টান টান করে পা ধরে আছে সাদা শার্টধারী লোকটা। যেন মালের গুদামে সাজানো মাল গুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে। আর মালগুলো যেন ছিটকে দুমড়ে মুচড়ে পড়ছে। গার্মেন্টসে আগুন লেগেছে, বেরুনোর কোন পথ নেই, শ্বাস নেওয়ার উপায় নাই, নিরাপত্তা আর জীবন বাঁচানোর ক্ষুদ্রতম সুযোগটা নাই। পিউ এর ফ্লাশে গোপনভাবে সারি সারি করে সাজানো মালগুলো ক্রমশ লাশ হয়ে ওঠে।


নোট: ২০১৩ তে প্রকাশিত, কামরা খণ্ড ২, দশটি ছবি দশটি গল্প থেকে নেয়া হয়েছে।



Copyright of the photograph belongs to Azizur Rahim Peu/ Drik/ Majority World. Any part of this article cannot be used without the written permission of the author.