নওয়াজেশ আহমেদ: বিমূর্ত ভালোবাসা
/ তানজিম ওয়াহাব

© নওয়াজেশ আহমেদ/ দৃক/ মেজরিটি ওয়ার্ল্ড
যদি না বাঁধ জড়িয়ে জড়িয়ে
ওদের ধরব কি করে,
ফুলদানিতে সাজাব কোন উপায়ে?
আমি বলি,
আজকে ওরা ছুটি-পাওয়া নটী,
ওদের উচ্চহাসি অসংযত,
ওদের এলোমেলো হেলাদোলা
বকুলবনে অপরাহ্ণে,
চৈত্রমাসের পড়ন্ত রৌদ্রে।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেষ সপ্তক
ছুটি পেয়ে রবীন্দ্রনাথের ফুলবাগানের ফুলগুলো অসংযত উচ্চহাসি দিলেও নওয়াজেশের ছবিতে তারা সম্পূর্ণ উল্টো ভঙ্গিতে। এখানে তারা প্রচণ্ড সংযত, পরিপাটিভাবে ফুলদানিতে সাজানো। এলোমেলোভাবে হেলাদোলার বদলে প্রচণ্ড স্থির, ঠাণ্ডা। চৈত্রের পড়ন্ত রোদ তাদের পিঠে এসে না পড়লেও জানালার ফাঁক দিয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাঁকাপথে আসার সময় কুঁচি কুঁচি হয়ে আলো কেটে আসছে জানালার গ্রিল থেকে। বকুলবনে নয়, নাগরিক পরিবেশে হয়তো কোনো এক ড্রইংরুম। ছবির গোটা অংশই যেন অন্ধকারের ঘুটঘুটে কালোতে ডুবেছে, আর সামান্য পরিমান বাঁকা আলোতে বের হয়ে আসে শুধুমাত্র ফুলদানির অবয়বটুকু। কালোতে মিশে ফুলদানিটা একটু বিষন্নতো বটেই। জ্যামিতিতে বাঁধা ছবি। অনেকগুলো রেখার বিন্যাস। আলোছায়ার তির্যক রেখা ছেদ করেছে পেছনের টাইলসের লম্বালম্বি আর সমতল রেখার সাথে।
ক্লোন চায়ের গবেষক, জেনেটিক বিজ্ঞানী নওয়াজেশ আহমেদ বাংলাদেশে আধুনিক ফটোগ্রাফির সূচনা করল। আধুনিক জীবনের এই নাগরিক পটভূমি জয়নুল, কামরুল আর নাইবুদ্দিনের গ্রাম বাংলার অন্বেষণ থেকে ভিন্ন। নওয়াজেশের স্টিললাইফ ছবিগুলোতে গুনটানা নেই, কাশবন কিংবা রাখাল বালক নেই, আছে শহরের পাকা ঘর, বৈদ্যুতিক তাঁর, মোজাইক কিম্বা টাইলসের রেখা। শিল্পীর ভাষায় সেটা কখনও এবস্ট্রাক্ট অথবা সেমি-এবস্ট্রাক্ট ফর্ম। শীতল অনুভূতিসর্বস্ব স্টিললাইফ ফটোগ্রাফি করার সাহস এদেশে তখনও কেউ করেনি, যখন নওয়াজেশ সিদ্ধান্ত নিল নির্জীব বস্তুকেই ছবিতে প্রাণ দিতে হবে। স্বাধীনতার অনেক আগেই, পঞ্চাশের দশকে নাইবুদ্দিন আহমেদ আর আমানুল হকের মতো বড় মাপের ফটোগ্রাফারের সাথে প্রথম প্রদর্শনী তাকে বাড়তি উৎসাহ দেয় ছবি তোলার, যদিও কখনই সেটা পেশা হয়ে উঠে নি।
পেশায় বিজ্ঞানী হবার সুবাদে দেশ-বিদেশ ঘুরেছে নওয়াজেশ, যার ষোলআনা কাজে লেগেছে পশ্চিমের শিল্প বুঝতে, নিজ চোখে তার স্বাদ নিতে। মনে, সেজান, ভ্যানগগ, পিকাসো, জগৎবিখ্যাত ইমপ্রেসনিস্ট, পোস্ট-ইমপ্রেসনিস্ট, কিউবিস্ট শিল্পীদের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমত বিস্মিত হয়েছেন। আধুনিক চিত্রকলাই তাকে টেনেছে বারবার। সে সময় আমেরিকার পোলক, রথকোদের এবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেসনিজমের সমান্তরালে বাংলাদেশের কিবরিয়া, মুর্তজারা বিমূর্ত চিত্র এঁকেছে। বিমূর্ত ছবির প্রতি নওয়াজেশের আকর্ষণের সাথে যেন যোগ হয়েছিল ছবির নতুন ভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার আগ্রহ। হয়তো এই গবেষণাধর্মী আচরণ বিজ্ঞানী নওয়াজেশ থেকে ধার নেওয়া। পশ্চিমে পঞ্চাশের বেশ আগেই এডওয়ার্ড স্টাইকেনের আলোছায়াতে ম্যাচের কাঠি কিংবা এন্দ্রে কার্টেজের বাটিতে দাঁড়ানো কাঁটাচামচ কিংবা পল স্ট্রান্ডর নিউইয়র্কের স্টিললাইফ সিরিজ ফটোগ্রাফিতে এরূপ ভাষা এনেছে। কিন্তু এদেশের ফটোগ্রাফির প্রেক্ষাপটে নওয়াজেশের এই সাদাকালো স্টিললাইফগুলো নয়া সম্ভাবনা জানান দেয়।
ব্যক্তি হিসেবেও নওয়াজেশ যাপন করেছে শহুরে জীবন, নিয়মিত আসা যাওয়া করেছে পশ্চিমে, ছবি তুলেছে ক্ষণে ক্ষণে। অপরদিকে বড় ভাই নাইবুদ্দিন পারিল গ্রামে স্থায়ীভাবে রূপসী বাংলার ছবি তুলেছে, লম্বা সময় ধরে। শিল্পীর যাপনের ভিন্নতা শিল্পে প্রভাব ফেলতেই পারে, আর ছবি তোলার ধরন বা চর্চা ছবির আবেদনকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দেয়। ফটোগ্রাফিতে অনেক ধারার চর্চাই রয়েছে। কোনো এক ধারার ফটোগ্রাফার ছবি তোলে প্রবৃত্তি আর ভাগ্য ভর করে, মানবিক কোনো মুহূর্ত বন্দি করে, যা ঝুঁকে জীবন ঘনিষ্ঠতার দিকে। অপর ধারায় ফটোগ্রাফার ছবি তোলে সচেতনভাবে, গোছালো কোন ভাবনা থেকে, জ্যামিতিক শৃঙ্খলায়, যা ঝুঁকে পড়ে নন্দনের শীর্ষ অনুভূতিতে। আগের ধারাটা যেমন বড্ড বেশি আবেগপ্রধান হতে পারে, বিপরীতে দ্বিতীয় ধারাতে হয়তো বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্পচর্চাই বেশি প্রকাশ পায়। নওয়াজেশের ফটোগ্রাফির ধরন যেন দ্বিতীয় ধারাতে মিলে যায়।
নোট: ২০১২ তে প্রকাশিত, কামরা খণ্ড ১, দশটি ছবি দশটি গল্প থেকে নেয়া হয়েছে।
Copyright of the photograph belongs to Noazesh Ahmed/ Drik/ Majority World. Any part of this article cannot be used without the written permission of the author.