আমানুল হক: আন্দোলন দলিলচিত্র
/ সাহাদাত পারভেজ

কপালে গুলি লেগে মাথার খুলি চূর্ণ হয়ে মগজ বেরিয়ে গেছে। মগজে জমাট বাধা রক্ত। ১৯৫২ সালের একুশের উত্তাল অপরাহ্ণে পুলিশের সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেই দৃশ্যের ছবি তোলেন আমানুল হক। তিনি ছবিটা তুলেছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেদিন পুলিশ যে হত্যার উদ্দেশ্যেই ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়েছিল সেটি আমানুলের ছবিতে স্পষ্টভাবে ধরা দেয়। আমানুলের তোলা একুশের প্রথম শহীদ; রফিকউদ্দিন আহমেদের বিমূর্ত ছবিটি এখন ভাষা আন্দোলনে বাঙালির আত্ম দানের একমাত্র দালিলিক চিত্র।
হিমশীতল করা ছবিটা সেই সময়ের শাসক গোষ্ঠীর মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বায়ান্ন পরবর্তী ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় কিংবা মুসলিম লীগের যে ভরাডুবি হয়; তার পেছনেও এই ছবির প্রচারণা বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। শাসকের দল চেয়েছিল লাশটি গুম করে দিতে। কিন্তু তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আমানুলের ছবি। পরিনামে তাকে কম মূল্য দিতে হয়নি। ছবিটি তোলার অপরাধে আমানুল পুলিশের নজরদারির লক্ষ্য হয়ে ওঠেন। নজরদারি এড়াতে তাকে পালিয়ে থাকতে হয়। তাতেও দশা কাটে না। ছবিটির কারণে ওই সময়ের এক প্রভাবশালী সম্পাদকের কাছ থেকে সরাসরি হুমকি পান, নিগ্রহের শিকার হন, চাকরি হারান। সবশেষে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হন।
কেমন করে বায়ান্নর ঐতিহাসিক ছবিটি তুলেছিলেন আমানুল; তার কাহিনী বেশ দীর্ঘ ও শ্বাসরুদ্ধকর। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান ঘটনাস্থল ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও এর আশেপাশের এলাকা। ২৭ বছরে তরুণ আমানুল তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছবি আঁকা ও ছবি তোলার কাজ করতেন। অ্যানাটমির ছবি এঁকে শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজে সহযোগিতা করতেন। ওই দিন যে কিছু একটা ঘটবে; আগে থেকেই টের পেরেছিলেন তিনি। তাই ক্যামেরা নামের প্রিয় যে যন্ত্র টি সব সময় তার গলায় ঝুলানো থাকতো, একুশের দিনে সেটি তিনি ফুল—হাতা হাওয়াই শার্টের পকেটে লুকিয়ে রাখেন।
সকাল থেকেই চারদিকে চাপা উত্তেজনা। ক্রমে সেই উত্তেজনা বাড়ে। দুপুরের দিকে পুরাতন কলাভবন [এখন যেখানে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগ], মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণ [বর্তমানে শহীদ মিনার সংলগ্ন স্থান] ও এর সামনের রাস্তায় পুলিশ বেপরোয়াভাবে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। ছাত্র—জনতার ইট—পাটকেল নিক্ষেপেও বেসামাল অবস্থা। সংঘর্ষ ক্রমেই বাড়ছে। বেলা তখন তিনটা। উত্তেজনার চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে পুলিশ ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে ঢুকে দু’দফা গুলি চালায়। আমানুল তখন হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। উৎকণ্ঠিত হয়ে এগিয়ে গেলেন। কয়েকজন ছাত্র ও যুবক একটি রক্তমাখা দেহ ধরাধরি করে নিয়ে আসছেন। ক্রোধে, ক্ষোভে একজন চিৎকার করে বলছেন, ‘ওরা গুলি করেছে, ওরা মেরে ফেলেছে।’ জানা গেল, গুলি বিদ্ধ ওই তরুণটির নাম আবুল বরকত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে ছাত্র—জনতা, ডাক্তার—নার্স, মেথর—কর্মী, এমন কী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকও কাঁদছেন।
আমানুল ধীর পায়ে ছাত্রাবাস এলাকায় যান। ছাত্রবাসের বারান্দা ও বাইরে নানা জায়গায় রক্ত। একটা জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তার মাঝখানে ছোট্ট একটি ইশতেহার। এক খণ্ড মাটির টুকরায় ইশতেহারটি চাপা দিয়ে রেখে গেছেন কোনো এক নাম না জানা ভাষা সংগ্রামী। ব্যাপারটা তার কাছে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো। পকেটে লুকানো ক্যামেরা দিয়ে দ্রুত ছবি তুলে জনতার কাতারে মিশে গেলেন আমানুল।
মেডিকেল কলেজের বারান্দার সামনের যে মাঠ, সেখানে প্রখ্যাত সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের সঙ্গে দেখা। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তান প্রচার দপ্তরের সহকারী পরিচালক। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও গুলিবর্ষণের খবর পেয়ে জাতির এমন দুর্দিনে বিবেকের তাড়নায় ছুটে এসেছিলেন। পূর্ব পরিচিত হিসেবে মোহাম্মদ ইদরিস আমানুলকে বললেন, ‘একজন ছাত্রের মাথার খুলি উড়ে গেছে। তার দেহটা হাসপাতালের পেছনের দিকে একটা ঘরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তুমি কি তার ছবি তুলতে পারবে?’ শুনে আমানুলের রক্তের ভেতর এক চাঙ্চল্য বয়ে যায়।
লাশ লুকিয়ে রাখার তথ্যটি কিছুক্ষণ আগে মোহাম্মদ ইদরিসকে জানিয়েছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্রী হালিমা খাতুন। দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন হালিমা। ইশারায় তিনজনের কথা হলো। হালিমার পিছু পিছু রওনা হন আমানুল। হাসপাতালের পেছনে একটি ঘর। ঘরটি গুদাম ঘরের মতো। সেই ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে একটি লাশ। আমানুলের কাছে একটি সাধারণ মানের ক্যামেরা। প্রায়ান্ধকারের মধ্যে খুব সাবধানে নিঃশ্বাস বন্ধ করে সীমিত শক্তির ক্যামেরায় শাটার চাপেন আমানুল। ছবি তুলে এক মুহূর্তও দেরি না করে হাসপাতাল ছেড়ে পালান।
বাসায় গিয়ে নিজের ডার্করুমে তিনটি ছবি প্রিন্ট করেন। সন্ধ্যার আগে আগে ইদরিস সাহেব আমানুলের বাসায় গিয়ে হাজির। তিনটি ছবি চেয়ে নিলেন। এর একটি কপি পাঠালেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মাজেদ খানকে। আরেকটি স্পোর্টস ফেডারেশেনের এ এস এম মহসিন সাজুকে। বাকি ছবিটির প্রিন্ট সন্ধ্যার মধ্যেই দৈনিক আজাদ অফিসে পাঠান। প্রখ্যাত সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন তখন আজাদের সম্পাদক। তিনি ছবিটা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেন। রাতে ছবিটির ব্লকও আসে। কিন্তু রাত দুইটার দিকে বাধে বিপত্তি। মালিক কর্তৃপক্ষের আপত্তি তে ছবিটি শেষ পর্যন্ত ছাপা হয়নি।
অধ্যাপক মাজেদ খানকে যে ছবিটি দেওয়া হয়েছিল পরে তা থেকে ব্লক তৈরি করা হয়। মাজেদ খানই ব্লকটি ছাত্রদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। ছাত্ররা একটি প্রচার পত্র লিখে তাতে ছবিটি ছাপেন। এই প্রচার পত্র পুলিশের হাতে যায় এবং পুলিশ প্রচার পত্রটি বাজেয়াপ্ত করে। পুলিশ নানাভাবে ছবিটির ব্যাপারে খোঁজ—খবর নেয়। তারা জানতে পারে, ছবিটি আমানুল তুলেছেন। পুলিশ আমানুলকে খুঁজতে থাকে। আমানুলের খোঁজে তারা একবার আজাদ অফিসে যায়। আমানুল ছিলেন ছোটখাটো ও রোগাপটকা গোছের। কিন্তু পত্রিকা অফিস থেকে জানানো হয়; এই ছবি যিনি তুলেছেন, তিনি ইয়া লম্বা, কালো আর মোটাসোটা।
আমানুল তখন ফেরারি হয়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ান। হাতে অর্থকড়ি নেই। তাই একদিন তিনি গেলেন এক পত্রিকা অফিসে, যেখানে তার ছবি ছাপা হতো। সম্মানী চাইতেই ওই পত্রিকার প্রভাবশালী সম্পাদক রফিকের ছবি তোলার অজুহাত দেখিয়ে আমানুলকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। আমানুল চাকরি ছেড়ে চলে যান আত্ম গোপনে। অনেক দিন আত্ম গোপনে থেকে পাড়ি জমান কলকাতায়। যাওয়ার আগে বড় ভাই আজমল হক এর স্ত্রী লুৎফা হক এর কাছে তিনি রফিকের নেগেটিভটি রেখে যান। লুৎফা হক বহু বছর তার ট্রাঙ্কে কাপড়ের ভাজে নেগেটিভটি লুকিয়ে রাখেন। এভাবেই রক্ষা পায় ভাষা আন্দোলনে বাঙালির আত্মদানের একমাত্র দলিলচিত্রের নেগেটিভ।
Copyright of the photograph belongs to Amanul Haque. Any part of this article cannot be used without the written permission of the author.