নাইব উদ্দিন আহমেদ: বাংলার জমিন


/ মুনেম ওয়াসিফ







© নাইব উদ্দিন আহমেদ‌/ দৃক/ মেজরিটি ওয়ার্ল্ড

ছবিটা বর্গাআকৃতির, যাকে ইংরেজিতে বলে মিডিয়াম ফর্মেট। মূল বিষয় বাদ দিলে ছবি দুটি অংশে সমান ভাবে বিভক্ত উপর অংশে মেঘলা আকাশ, নিচে ভরাট নদী। মাঝে নদী আর আকাশ ভাগ করেছে দূরে মিলে যাওয়া গ্রামের সবুজ সীমান্ত। ছবির পিছনে বাম দিকে একটি পাল তোলা নৌকার সামনে গ্রামের এক কিশোর আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে। চিরাচরিত বাংলার ছবি! নাইব উদ্দিন আহমেদ তাই চেয়েছিলেন। এই বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের ছবি তুলতে। বাংলার নদী, নারী, কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ, প্রকৃতির ছবি। তিনি বড় হয়েছেন মানিকগঞ্জের পারিল গ্রামে। ১৯৪১ সালে কলকাতা থেকে মামার এনে দেয়া কোডাক ব্রাউনি ক্যামেরা দিয়ে তিনি আলোকচিত্র চর্চা শুরু করেন। কিন্তু ছবি তোলা হলেই তো হবে না, সেই নেগেটিভ ধোলাই করা থেকে প্রিন্ট তৈরি পর্যন্ত সব কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। অন্ধকার ঘর, টেবিলের চারপাশে কাঁথা মুড়ানো আর হারিকেনের লাল সেলোফেন থেকে আসা আলতো আলো দিয়ে চলত ডার্করুমের কাজ। পানির ভিতর থেকে একটি সাদা কাগজ। লাল আলো। তার ভিতর থেকে আস্তে আস্তে ছবি বেরিয়ে আসতে দেখার যে কি প্রবল উত্তেজনা, তা এই প্রজন্মের অনেক আলোকচিত্রী বুঝবে না।

মেট্রিক পাশ করে ১৯৪৩ সালে যখন কলকাতা ইসলামিক কলেজে ভর্তি হন, সেই সময় তার পরিচয় হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন-এর সঙ্গে। তেতালিস্নশের দুর্ভিক্ষে কলকাতার অলিতে গলিতে তিনি জয়নুল আবেদিন-এর সাথে ঘুরেন। তার সাথে সখ্যতার প্রভাব আমরা নাইব উদ্দিনের ছবিতে দেখতে পাই। গুন টানা, লাঙ্গল, গরুর গাড়ি, সাঁওতাল, গ্রামের নারী, এই ছবিগুলোতে জয়নুল থেকে নাইব উদ্দিন অথবা নাইব উদ্দিন থেকে জয়নুল বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। কিন্তু এই দুই শিল্পীর সম্পর্ক কেবল বিষয়ের বেলায় নয়, এমনকি ফর্মের ক্ষেত্রেও পুরোমাত্রায় হাজির। এই দুই শিল্পীর গুন টানার ছবিতে একই ফর্ম বার বার ফিরে আসে। জয়নুলের মতো নাইব উদ্দিনের ছবিতে ছিলো অদ্ভুত সারল্য ও পরিমিতি বোধ। ক্যামেরা ছোট হওয়ার কারণে যখন ইউরোপে মুহূর্ত ধরবার দৌড় চলছে, নাইব উদ্দিন তখন বাংলায় আপন মনে ছবি তুলে যাচ্ছেন, সময় নিয়ে। তার ছবির মুহূর্ত অনেক স্থির, ভাস্কর্যের মতো। তার মানুষেরা নানান আকার নিয়ে সামনে এসেছে। তবে সেই আকার কিংবা দৈহিক ফর্ম কখনো তার কাছে এবস্ট্রাক্ট বা প্রতীকী হয়ে উঠেনি। তিনি গ্রামের কৃষক, নারী, শ্রমিক সবাইকে তার নান্দনিক বোধ দিয়ে মানুষ হিসেবেই দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু অন্য দিকে তার ছোট ভাই নওয়াজেশ আহমেদ অনেক বেশি এবস্ট্রাক্ট ফর্মের দিকে ঝুঁকে গিয়েছিলেন। একটি বড় কারণ হয়তো নওয়াজেশ আহমেদের বিলেত ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। কিন্তু নাইব উদ্দিনের চোখ তখনও সরল প্রেমে ভরা, কৃষকের সাথে তার ফসলের সম্পর্কের মতো।

নাইব উদ্দিনের ছবিতে মেঘময় আকাশ আর বাংলার জমিন, সেই জমিনে কখনো কৃষক, কখনো জেলে, কখনো গ্রামের বধূ কিংবা কখনো সাঁওতাল যুবক। কিন্তু নাইব উদ্দিনের বাংলা কি কেবলই সুন্দর? তা নয়, নাইব উদ্দিনের সবচেয়ে শক্তিশালী কাজ ১৯৭১ সালে তোলা যুদ্ধের ছবি। যেখানে বাংলার আকাশে কোন মেঘ নেই, কেমন জানি ফাঁকা! সেখানে বাংলার পুরুষেরা আর লাঙ্গল হাতে দাড়িয়ে নেই, তুলে নিয়েছে রাইফেল অথবা অপর মুক্তিযোদ্ধার লাশ। পুরো ফ্রেম জুড়ে রয়েছে ক্ষুধার্ত শিশু আর হাড় জিরজিরে শরীর। তাদের শরীরে আগের মতো সেই স্পন্দন আর নেই, তারা ক্লান্ত। একাত্তর-এর নাইব উদ্দিনের কাজ অনেক আবেগী, লড়াকু ও শ্রদ্ধাশীল। যা তিনি সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত জায়গা থেকে নিছক ডকুমেন্ট করার জন্য করেননি, এই বাংলার প্রতি তার ভালোবাসা থেকেই করেছেন। এই আবেগী শিল্পী, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের বর্বর আক্রমণে যে মানসিক কষ্ট পেয়েছেন, তার পর জীবনে আর কোন দিন ছবি তোলেন নি।


নোট: ২০১২ তে প্রকাশিত, কামরা খণ্ড ১, দশটি ছবি দশটি গল্প থেকে নেয়া হয়েছে।



Copyright of the photograph belongs to Naib Uddin Ahmed/ Drik/ Majority World. Any part of this article cannot be used without the written permission of the author.