সাইদা খানম: অমীমাংসায় প্রারম্ভ


/ জান্নাতুল মাওয়া








© সাইদা খানম


নিসর্গের ঠিক মাঝখানে ছবিটির আত্মা হয়ে বসে আছেন এক নারী। ছড়ানো কালো আঁচল। উন্মুক্ত চুল নয়, বিনুনি দিয়ে বিনুনি বাধা। ইঙ্গিত স্পষ্ট। চাইলেই তার পানে ধাবিত হওয়া যায় না। অথচ আড়াল করে রাখা মুখশ্রীটা-ই অমোঘ এক আকর্ষণ !

ছবিটি আলোকচিত্রী সাইদা খানমের ভাবতেই ধাক্কা লাগে। আমরা যে সাইদা খানমের ছবি দেখি সেখানে তাঁর ছবির নারীরা সাধারণত স্পষ্ট, রিয়ালিস্টিক। বিষয়বস্তু বয়ানও পার্থিব। সেই সব ফ্রেমে নারীরা ছবি আঁকেন, নৌকায় ভাসেন, মোনাজাত ধরেন, কেউ আলো ছায়ায় একাকার হয়ে থাকেন জানালায় ; পুরনো বারান্দায়, আবার কেউ কেউ বন্দুক হাতে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে।

কিন্তু এ ছবিটা সুররিয়াল। মিডিয়াম ফরম্যাটে মূল বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে লং শটের সুরেলা কম্পোজিশন। নারীর শৈলী, পোশাক, ধরণ বলে দেয় ষাটের দশকের কোনো একসময়। হতে পারে চট্টগ্রামে; ইসলামাবাদে কিংবা ভারতের কোনো মনোরম স্পটে তোলা।*

কারিগরি দিক ও নান্দনিকতায় এই ছবিটি যতটা শক্তিশালী তার চেয়েও শক্তিশালী মনে হয় তাঁর বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করার ঢং। মুখশ্রী আড়াল করে একই সঙ্গে দূর এবং পেছন থেকে নারীকে দেখানোর প্রবণতা। যা আলোকচিত্রের জায়গা থেকে বেশ ব্যতিক্রম। একজন নারী তার ক্যামেরায় অনূদিত করছেন আরেকজন নারীকে। ছবির মানুষটিকে চিহ্নিত করা যায় না বলে ছবিটি ব্যক্তিগত ভ্রমণ থেকে উন্মুক্ত হয়ে যায় সবার জন্য। ওটা আর ছবির নারীর কিংবা সাইদা খানমের একক ভ্রমণ থাকে না। নারীটি হয়ে উঠে আমি, তুমি, সে। সে নারী কখনো স্বাধীন, বিমূর্ত, একাকী অথচ নিশ্চিন্ত।

শুধু এই ছবিতেই নয়, একক নারীকে প্রকৃতির সামনে কাছাকাছি ভঙ্গিতে আরো কিছু ছবিতে প্রকাশ করেছেন সাইদা খানম। এই মিলগুলো কি কাকতালীয় ? নাকি নারীকে এভাবে দেখাবার প্রবণতা সাইদা খানমের সচেতন সিদ্ধান্ত বা অবচেতন প্রকাশ? তা একমাত্র সাইদা খানম-ই বলতে পারতেন। কিন্তু এ ছবিগুলো যখন উদ্ধার হলো তখন সাইদা খানম সব তথ্য নিয়ে চলে গেছেন অনন্ত যাত্রায়।

অতীতে তাঁর রিয়ালিস্টিক ছবির ধরণ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলতেন, 'ধুর, আমি তো এত কিছু ভাবিনি ।' সাইদা খানম কি আসলেই ভাবেন নি? সদ্য প্রকাশিত ছবিগুলো তো তা বলে না।

তার জীবনী এবং বহু কথোপকথন থেকে জানা যায় , তিনি শৈশব-কৈশোরে প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। নিরাময়ের জন্য হাওয়া বদলে মাসের পর মাস থেকেছেন দেশ-বিদেশের পাহাড়-সমুদ্র-জঙ্গলে। জীবন সংক্রান্ত বোঝাপড়ার অনেকখানিই স্কুলের চেয়ে প্রকৃতির কাছ থেকে শেখা। পরিণত বয়সে ভ্রমণের ছলে সময় পেলেই ক্যামেরা আর কাছের মানুষদের প্রকৃতির কাছে টেনে নিয়ে যেতেন। আর প্রকৃতি কে সাক্ষী করে রচনা করতেন নারীর নানা আকাঙ্ক্ষা-বাসনার প্রতিকৃতি। সম্প্রতি তাঁকে নিবিড় ভাবে পাঠ করতে গিয়ে মনে হয়েছে এই ছবিগুলো যেন অন্তর্মুখী সাইদা খানম এর-ই আত্ম প্রতিকৃতি!

ছবি ভাবনার এ পর্যায়ে এসে মনে হলো আমার থামা উচিত। বরং আলোকচিত্র শিক্ষার্থীরা এই নতুন ছবির মধ্যে দিয়ে সাইদা খানমের দেখা-অদেখা কাজ গুলো নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠুক। নিজেদের মতো করে অনূদিত করুক তাঁর কাজ কে। মীমাংসা নয় বরং অমীমাংসায় খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত থাকুক গুপ্ত করে রাখা সাইদা খানমকে। যিনি হারিয়ে গেছেন 'দেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী, 'সত্যজিৎ রায়ের সান্নিধ্য'র মতো চর্বিত চর্বণ পরিভাষায় !




*ষাটের দশকে তিনি এই জায়গা গুলো ভ্রমণ করেছেন। বিভিন্ন সময় তাঁর এবং তাঁর বন্ধুদের কাছে থেকে শোনা। এখানে তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন সাইদা খানমের প্রিয় বন্ধু নাট্য ব্যক্তিত্ব আলেয়া ফেরদৌসী।


নোট: এই ছবিটি সংশ্লিষ্ট লেখায় ব্যবহার ব্যাতিত অন্য কোথাও ব্যবহারের অনুমতি নাই।


Copyright of the photograph belongs to Sayeeda Khanam. Any part of this article cannot be used without the written permission of the author.